Ticker

6/recent/ticker-posts

Ad Code

গানওয়ালাদের ভিড়ে ফিরে এলেন সঞ্জীব চৌধুরী

 গানওয়ালাদের ভিড়ে ফিরে এলেন সঞ্জীব চৌধুরী



আল মাহফুজ

গানওয়ালা বলতে বোঝানো হয় সিঙ্গার-সং রাইটারদের। ‘সিঙ্গার-সং রাইটার’ হলেন, যারা নিজের লিরিকে নিজেই সুর বেঁধে সেটি কণ্ঠের মোহনায় বয়ে নিয়ে যান। এটি একটি সর্বজনবিদিত টার্ম বিশ্ব সংগীতে। মানে গানের গীতিকার, সুরকার ও গায়ক যদি একজনই হন, তিনি হবেন সিঙ্গার-সং রাইটার।


বাংলাদেশে কয়েক দশক আগেও এই সিঙ্গার-সং রাইটারদের তেমন দেখা যেতো না। বিরলপ্রজ ছিল। তবে পশ্চিমবঙ্গে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ কিংবা সুমন-অঞ্জন-নচিকেতার নিউ ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে। বাংলাদেশেও তার আঁচ এসে লেগেছে। এই প্রসঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীর নাম বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।


বাংলাদেশে আধুনিক বাংলা গানে তিনি দেখালেন সিঙ্গার-সং রাইটাররা কেমন হয়। তার আগে ছিলেন মাকসুদুল হক, তবে সেটা ব্যান্ড মিউজিকে। সঞ্জীব নিজে যেমন লিখতেন, তেমন অন্যের কবিতায় সুর বসিয়ে সেটা নিমেষেই সেদ্ধ গান বানিয়ে দিতেন। সঞ্জীবের লিরিক বা গান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন অনেকেই। অনেক সিঙ্গার-সং রাইটারদের কাছে সঞ্জীব ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন শাখা প্রশাখা বিস্তৃত বিশাল এক মহীরুহে।



গানওয়ালাদের মহীরুহ সঞ্জীব চৌধুরী


সঞ্জীবের আগে এসেছিলেন সাহেদ-তরুণ মুন্সীরা। পরবর্তীতে প্রীতম আহমেদ, দীপ্ত, অটামনাল মুন, লিমন, সায়ান, জয় শাহরিয়ার, তপুসহ আরও অনেকেই এসেছেন; যাদের সিঙ্গার-সং রাইটার অভিধায় ভূষিত করা যায়। যারা একের ভেতর তিন– গীতিকার, সুরকার ও গায়ক। যারা গানওয়ালা।


কিন্তু এসব গানওয়ালাদের নিয়ে এক প্ল্যাটফর্মে গানের আয়োজনের কথা খুব শোনা যায় না। এবার রাজধানীতে তেমনই এক কনসার্টের দেখা মিললো সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘আজব কারখানা’র উদ্যোগে। নাম ‘গানওয়ালাদের গান’। কারণ, এখানে যারা গান গেয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন, তারা সবাই সিঙ্গার-সং রাইটার।


শুক্রবার (২ নভেম্বর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ঢাকা ট্রেড সেন্টারে (দ্য অ্যাটেনশন নেটওয়ার্ক) অনুষ্ঠিত সেই আয়োজনে গানের মঞ্চে ঝড় তুলতে দেখা গেলো সাত গায়ক-গীতিকার-সুরকারকে। গানওয়ালাদের গানে পারফর্ম করেছেন লিমন, আহমেদ হাসান সানি, সভ্যতা, শুভ্র, সুহৃদ স্বাগত ও ব্যান্ড ‘কাকতাল’। গানওয়ালাদের ভিড়ে এখানে যেন ফিরে এলেন প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরীও।


অনুষ্ঠান শুরুর কথা ছিল বিকেল সাড়ে ৪টায়। সেটা গড়াতে খানিক বিলম্ব হলেও প্রথম শিল্পী হিসেবে সুহৃদ স্বাগত বাজিমাত করে দিলেন। তিনি শোনালেন তিনটি গান। ‘গানওয়ালাদের কথা’, ‘ফুরিয়ে গেছে’, ‘শেষ বিকেলের আলোয়’। ‘গানওয়ালাদের কথা’ অনেক দিন মনে থাকবে।



গান গাইছেন শুভ্র


এরপর মঞ্চে উঠলেন রায়হান ইসলাম শুভ্র। এই তরুণ গানওয়ালা গানগল্পে পর্যায়ক্রমে শোনালেন ‘আমি তোমার মতো নই’, ‘দাঁতে ব্যথা’, ‘আমার খুব টাকা দরকার’। ‘বোকা প্রেমিক’, ‘আমার ক্লান্ত বিকেল’ গান শুধু গাইলেন না, বরং শোনালেন তার অন্তরালের গল্প। ‘দিশেহারা তুই’ যখন শুভ্র কণ্ঠে ধরলেন, হলরুমের প্রায় সব তরুণ তার সঙ্গে গেয়ে উঠছিল। এই গান যে এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত, দুই বাংলায় জনপ্রিয়।


তারপর স্টেজে ‘কাকতাল’। যে ব্যান্ডটি গড়ে উঠেছিল জেলখানায় বসে। সেই কাকতাল এখন বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় এক গানের দল। কাকতালের ভোকালিস্ট আসিফ ইকবাল একজন গানওয়ালা। ব্যান্ডের বাকি দুই সদস্যকে নিয়ে কাকতাল যখন পারফর্ম করছিল, মনে হচ্ছিল, ঘড়ির কাটা থমকে গেছে। মনে হচ্ছিল, হেমন্তের সন্ধ্যার বাতাস গায়ে শান্ত পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কাকতাল করলো ‘কিছু নেই’, ‘চরকি’, ‘আজিমপুর কলোনি’, ‘ওপেন সিক্রেট’, ‘অদ্ভূত’সহ ছয়টি গান। ‘আবার দেখা হলে’ দিয়ে যবনিকা ঘটলো তাদের অংশের।


মঞ্চে হাজির আরেক গানওয়ালা জয় শাহরিয়ার। এই আয়োজনের উদ্যোক্তা আজব কারখানার কর্ণধারও তিনি। শোনালেন একে একে ‘তোমাকে আসতেই হবে’, ‘যতোটা দূরে গেলে’, আনরিলিজড গান ‘বোকা’, ‘আমি তো এমনই’। ‘সুন্দরী’ গানের প্রসঙ্গে কাছের শ্রোতার বক্রোক্তির মজার গল্পও শোনা গেলো তার মুখ থেকে। শোনালেন আগামী বছর তার পঞ্চম অ্যালবাম আসার সুখবরও। ‘সত্যি বলছি’ যেন তিনি গাইলেন না, শ্রোতা-দর্শকই গাইলো। এই গান একদা রটে গেছিল অভিমানী প্রেমিকের মুখে মুখে....


গাইছেন শিল্পী ও আয়োজক জয় শাহরিয়ার

এবার আহমেদ হাসান সানি। ‘সব প্লাস্টিকের পুতুল’ তাকে দুবার গাইতে হলো বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে। ‘আমারে উড়াইয়া দিও’, ‘পথের গান’ যখন গাচ্ছিলেন, তার চোখে-মুখে খানিক অস্বস্তি দেখা যাচ্ছিল। বিদ্যুৎ না থাকায় হয়তো বেশ গরম বোধ করছিলেন এই গানওয়ালা। এরপর গাইলেন তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘আমরা হয়তো’। ‘শহরের দুইটা গান’ গাওয়ার অনুরোধ ছিল দর্শকদের পক্ষ থেকে। আল মাহমুদ ও মুয়ীয মাহফুজের দুটি কবিতাকে এক বিন্দুতে মিলিয়ে মঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন সানি।

এরপর এলেন সভ্যতা। অনুষ্ঠানের একমাত্র নারী গানওয়ালা। গাইলেন ‘যদি থাকতো ডানা’, ‘তোমাকে’র মতো তার জনপ্রিয় গান। ‘আয়না বালামা’ নামের একটি ঠুমরিও কণ্ঠে জড়ালেন। গাইলেন মুক্তি না পাওয়া গান ‘ঈশ্বর’, ‘ত্রিরত্নের গান’। এরপরই যেন অ্যাটেনশন নেটওয়ার্কের সব অ্যাটেনশন চলে গেলো সভ্যতার দিকে। সভ্যতা ফিরিয়ে আনলেন প্রিয় সঞ্জীবকে। সবার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বললেন– ‘আমি তোমাকেই বলে দেব, কী যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে..

ঠিক যেন তখন ‘সঞ্জীব’ হয়ে গানওয়ালাদের গানে ফিরে এলেন সঞ্জীব চৌধুরী। ঢাকার রাস্তায় যারা এখনও হাহা শুন্য বুক নিয়ে ‘সঞ্জীব দা’কে খুঁজে বেড়ায়, তারা যেন তখন সঞ্জীবনী সুধা পেলো। তারা সবাই গলা ছেড়ে গাইলো কাউকে নাম না বলা সেই গান। পলকা হাওয়ার মতো তাদের মনে হলো, সঞ্জীবরা বুঝি ফিনিক্স পাখি। তাই যুগে যুগে এই গানওয়ালারা হাজির হন। সঞ্জীব এদের বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন, মরে মরে বেঁচে থাকার নাম জীবন নয়।

দলের সঙ্গে গাইছেন লিমন


অনুষ্ঠানের শেষ শিল্পী লিমন এলেন। মঞ্চে উঠলেন। আলো নিভিয়ে দিতে বললেন। আলো নিভে গেলো। রাতের সামিয়ানায় সুনসান দর্শক। মুহুর্মুহু হচ্ছে গান। ‘মন ছুটছে’, ‘বৃষ্টির জন্য গান’, ‘কতদিন যে আমি’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘বর্ষা’, ‘কিছু যদি মনে পড়ে তোমার’। ‘জেলখানার চিঠি’ দিয়ে লিমন শেষ করলেন এবারের মতো গানওয়ালাদের গান। তবে শ্রোতা-দর্শকদের কেউ কেউ দাবি জানালেন, গানওয়ালাদের পরের আসরেও গান শোনার।


অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কথা ছিল রাত নটায়। সেটা কখন যে ১১টায় গড়ালো, টের পাওয়া গেলো না। গানওয়ালারা বোধহয় এমন হয়। তারা তাদের গান শুনিয়ে এতোটাই মশগুল করে রাখেন যে, তাতে ঘোরের সৃষ্টি হয়। সেই ঘোর কাটানো মুশকিল। ঘোরের পর্দা না সরুক। এই মুশকিল আসানের প্রয়োজন নেই..

Post a Comment

0 Comments